আর্থ-সামাজিক পরিচয়েআরজ আলী মাতুব্বর ছিলেন এই অতিসাধারণ
বাংলাদেশেরই সাধারণ একজন মানুষ।কৃষকের সন্তান, এক সময়ে প্রায় সর্বহারা হয়ে
পড়েছিলেন, বসত বাড়িটুকুছাড়া সম্পত্তি বলতে আর কিছু ছিল না।
আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া খুবই সামান্য, মক্তবে ভর্তি হয়েছিলেন, সম্পূর্ণ করতে
পারেন নি। কৃষিকার্যে নিয়োজিতছিলেন, পরে যে কাজে ব্যাপৃত হয়েছিলেন সেটাও
আমিনের, অর্থাৎ ভূমির মাপজোক ওদাগ কাটার। বেশভূষায় সাধারণ, - আচার আচরণেও সে-রকমই। চমক ছিল নাজীবনযাপনে। কিন্তু এই যে তাকে স্মরণ
করছি আমরা, তিনি বিষয়বস্তু হচ্ছেনআলোচনার, এর কারণ কি? কারণ তার জিজ্ঞাসা। জিজ্ঞাসাই তাঁকে অসাধারণ করেছে, তাকে স্থান করে দিয়েছে দার্শনিকদের সঙ্গে।জিজ্ঞাসা জিনিসটা কৌতুহলের মতো বটে, কিন্তু কৌতুহলের চেয়ে বেশি। জিজ্ঞাসারপেছনে চালিকা শক্তিটা কৌতুহলই; কিন্তু তাই বলে জিজ্ঞাসা যে কেবল কৌতুহল তানয়। জিজ্ঞাসায় অতিরিক্ত যা থাকে তা
হলো জানবার, বুঝবার এবং পরীক্ষা করেনেবার আগ্রহ। আরজ আলী মাতুব্বর অবশ্যই
জ্ঞানী ছিলেন, নিজের চেষ্টাতে অনেকবই তিনি পড়েছেন, এবং তার কোনো বিরাম ছিল না নানা বিষয়ে অধ্যয়নের।
কিন্তুজ্ঞানের চেয়েও বড় ছিল তার জিজ্ঞাসা, যা থাকে বলেই দার্শনিকেরা দার্শনিকহন।আমাদের সমাজে দার্শনিক দারিদ্র্য খুব ব্যাপক ও গভীর।
অন্যমনস্কতা অনেকেরমধ্যেই আছে।
কল্পনাশক্তিও দেখা যায়। কিন্তু প্রকৃত দার্শনিকতার মধ্যে যেজিজ্ঞাসা থাকে, এবং জিজ্ঞাসার অভ্যন্তরে কাজ করে যে যুক্তিবাদিতা তাদুর্লভ। এর ব্যাখ্যা অবশ্যই আছে। একটা
কারণ অর্থনৈতিক দারিদ্র্য। কিন্তুসেটা একমাত্র কারণ নয়; দরিদ্র হলেই যে
দর্শনবিমুখ হতে হবে এমনটা অনিবার্যনয়, যেমন অনিবার্য নয় বিত্তবান হলেই দার্শনিক
হওয়া। আরজ আলী তো দরিদ্রইছিলেন। আমাদের বিদ্যমান দার্শনিক দারিদ্র্যপীড়ার আরো কারণ রয়েছে। আছেআমাদের অল্পেসম্ভষ্টি। আমাদের দেশে
ভূমি উর্বর, প্রকৃতি সুপ্রসন্ন। জীবনযাপনের উপকরণ সহজে পাওয়া যায়, এবং তা পেয়েই লোকে সম্ভষ্ট হয়ে পড়ে। ওইযে বলা হয় বাংলাদেশের মানুষকে দেখলে
মনে হয় তারা খুব সুখী, তার কারণএখানকার মানুষ অভাবী হলেও তাদের অভাববোধটা খুব তীব্র
নয়।বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে দূরে যাওয়া
কঠিন। সবসময়েই আমরা প্রান্তবতী, দুইদিকে আমাদের
পাহাড়-পর্বত, একদিকে সমুদ্র। পাহাড়-পর্বত অনড়, সমুদ্রওখোলা নয়। সমুদ্রকে দস্যু ও বিদেশী ব্যবসায়ীরা করতলগত করে রেখেছে। আরোক্ষতিকর যা তা হলো পরাধীনতা। পরাধীনতা
বড় গভীরে চলে যায়, সংস্কৃতিকে নিচুকরে রাখে, এবং মেরুদণ্ডকে দুর্বল করে দেয়, স্বাধীন চিন্তা ভীষণভাবেনিরুৎসাহিত হয়।আমাদের শুধু একটা জায়গাতেই স্বাধীনতা ছিল, সেটা ধর্মচর্চা। মানুষ এই কাজবেশ উৎসাহের সঙ্গে করেছে। নিপীড়ন ছিল সমাজে; বিচারের অভাব ও আশ্রয়েরঅনিশ্চয়তা নিত্যদিনের ঘটনা। এসব উৎপাত মানুষকে ধর্মের
দিকে যেতে উৎসাহিতকরেছে। ধর্মের
ভিত্তি হচ্ছে বিশ্বাস, সেখানে ব্যাখ্যা চলে, জিজ্ঞাসা অচল।ধর্মের সঙ্গে দর্শনের সম্পর্ক মৈত্রীর নয়, বৈরিতার বটে।আরজ আলী
মাতুব্বর এই দরিদ্র, অল্পেসন্তষ্ট ও অবরুদ্ধ সমাজেরই
মানুষ। তিনিগ্রামেই থাকতেন। বরিশাল শহরে প্রায়ই
গেছেন, তবে থাকেন নি, এবং রাজধানীঢাকায় এসেছেন কদাচিৎ। বৃত্তের ভেতরেই ছিলেন আসলে। কিন্তু সেখানে থাকতেসম্মত হন নি। বেরিয়ে এসেছেন
মানসিকভাবে।এরকম ব্যতিক্রম অবশ্য আগেও দেখা গেছে।
যেমন লালন ফকির ও তাঁর অনুসারীবাউলেরা। এঁরাও ভূমির কাছাকাছি ছিলেন। এদের কারো কারো পেশা ছিল কৃষি, অন্যদের কৃষিসংলগ্ন কুটির শিল্প। লালন ও তার
সম্প্রদায়ের মানুষেরা জীবন, অস্তিত্ব, ইহকাল-পরকাল, পরিবেশ সম্পর্কে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছেন।উত্তরও দিয়েছেন। এই প্রশ্ন ও তার উত্তর তাদের গানে
রক্ষিত রয়েছে। এসব গানকবির লড়াইয়ের ফল নয়; একেবারেই
স্বতন্ত্র। কবির লড়াইয়ে তর্কবিতর্কথাকে, বলা যায় বিতর্ক চলে। বিতর্কও
প্রয়োজনীয় বটে, কিন্তু লালন যাকরেছেন তা বির্তক নয়, সে হচ্ছে দার্শনিক জিজ্ঞাসার সমাধান খোঁজা। বিতর্কেরতুলনায় তা বহুগুণ অধিক জরুরী। এখানে
জয়-পরাজয় নেই, আছে জানা এবং বোঝা।আরজ আলী মাতুব্বরও এই কাজটাই করেছেন।
অবশ্যই এর চেয়ে অনেক উন্নত পর্যায়েওই রকমের জিজ্ঞাসা দার্শনিক সক্রেটিসেরও ছিল। সক্রেটিস যে অজ্ঞ ছিলেন তা তোনয়, তিনি তার শ্রোতাদের সঙ্গে অবশ্যই অতুলনীয় ছিলেন, প্রশ্নের উত্তরওজানতেন, কিন্তু অগ্রসর
হতেন প্রশ্নোত্তরের মধ্য দিয়ে, যাতে
সঙ্গীদেরকেসাথে নিয়ে ধাপে ধাপে বুঝে বুঝে এগোনো
যায়। আরজ আলী মাতুব্বর সক্রেটিস নন; গ্রীকদের দার্শনিক ঐতিহ্যের ধারা থেকে অনেক দূরে তিনি, কিন্তু তারপদ্ধতিটাও সক্রেটিসের মতোই। সজীব, দ্বান্দ্বিক, এবং কিছুটা কৌতুক মিশ্রিত।আরজ আলী মাতুব্বরের মেরুদণ্ড ছিল
সোজা। প্রচলিত বহু চিন্তারঅন্তঃসারশূন্যতা তিনি জানতেন; তাদের সঙ্গে আপোস করেননি। যে জন্য তাকে ঝুঁকিনিতে হয়েছে। প্রচলিতকে রক্ষা করবার জন্য ছিল রাষ্ট্র, ছিল সমাজ। রাষ্ট্র ওসমাজের পাহারাদারির লোকেরা দেখেছে তার চিন্তা যদি প্রচার
পায় তাহলে তাদেরপ্রতিষ্ঠিত
স্বার্থ বিপন্ন হবে; সাধারণ মানুষ তাদেরকে মানবে না।
সেজন্য এইদার্শনিককে তারা যে কেবল নিরুৎসাহিত
করেছে তা নয়, ক্ষতিগ্রস্ত করতেওচেয়েছে। আরজ আলী দমেন নি। আত্মসমপণ
করেন নি। জিজ্ঞাসা নিয়ে তিনি এগিয়েগেছেন।তিনি একেবারেই স্থানীয়। তাঁর ভাষা
খুবই সাধারণ। সেখানে আড়ম্বর নেই, ওজস্বিতা নেই, অলঙ্কার অনুপস্থিত। আবেগ নয়, তার বক্তব্যের প্রধান ভিত্তিহচ্ছে যুক্তি। তার ওই যুক্তিপূর্ণ কথাগুলো নিজের জোরেই
এগিয়ে যায়; মুগ্ধকরে না, চিন্তিত করে।তার অসামান্যতা বহুজনের সামান্যতাকেই
জানিয়ে দেয়। কিন্তু তাই বলে তারলেখার কোথাও যে কোনো দম্ভ রয়েছে তা নয়, বরঞ্চ আছে পাঠকের সঙ্গে মৈত্রীস্থাপনের অভিপ্রায়। শিক্ষক নন, তিনি সঙ্গী।আমরা সংস্কৃতির
কথা, সামাজিক অগ্রসরমানতার কথা বলি। কিন্তু
আমাদের সমস্তঅর্জনের অভ্যন্তরে একটা দৈন্য থাকে।
সেটা চিন্তার। যে জন্য, আমাদের সমাজেবিজ্ঞানকে দেখা যায় উপকরণ হিসাবে, দেখা যায় না দৃষ্টিভঙ্গির অংশ হিসাবে।আরজ আলী মাতুব্বর বিজ্ঞানী নন, কিন্তু তার দৃষ্টিভঙ্গি বৈজ্ঞানিক এইদৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সংস্কৃতি ও সমাজে
খুবই প্রয়োজন।গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সমাজ কখনোই
গড়ে উঠবে না যদি বৈজ্ঞানিকতা না-থাকে, যে বৈজ্ঞানিকতার অন্য একটা নাম হচ্ছে দার্শনিকতা।আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে এই www.arojalimatubbar.com সাইটের মধ্য দিয়ে আরজ আলীমাতুব্বরের অসামান্যতা নতুন করে স্পষ্ট করা। আমরা সেই
দিনের প্রতীক্ষায়থাকবো যখন তিনি
ব্যতিক্রম থাকবেন না, নিয়ম হবেন, এবং ঘরে ঘরে তার মতোজিজ্ঞাসু মানুষদেরকে পাওয়া যাবে।আরজ আলী মাতুব্বরের জীবনী রচনা, তার রচনা সংগ্রহ, তার বক্তব্য প্রচার করারলক্ষ্যে আমাদের যাত্রা শুরু। আশা করি আপনাদের সাথে পাবো।উপরের লেখাটি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরি
রচিত; এই সাইটের জন্য কিছুটা পরিমার্জন ওসংযোজন করা হয়েছে।: http://www.arojalimatubbar.com/p/about.html