উপমহাদেশের দীর্ঘতম নদী কোনটা?

সেই কন্টিনেন্টাল ড্রিফটের সময়, ভারত উপমহাদেশ দৌড়ে এসে বুডুম করে ধাক্কা মেরে বসলো ইউরেশিয়ান প্লেট আর বার্মা প্লেট-কে। তাদের মাঝখানে গজিয়ে গেল হিমালয়সুদ্ধ তামাম পাহাড়ের দেয়াল, আর তিনদিকে দেয়াল তুলে আলাদা হয়ে বসে রইলো আমাদের উপমহাদেশ। পশ্চিমে যার একটা দরজা, বিখ্যাত খাইবার পাস, আরেক দরজা পূবে, পাটকাই। উপমহাদেশের এই দেয়াল থেকে নেমে কত কত হিমশৈল নদী হয়ে বয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই।

এর মাঝে সবচে লম্বা পথ পাড়ি দিয়েছে যে, তার নাম ব্রহ্মপুত্র। কৈলাস রেঞ্জে তার উৎপত্তি, সোজা পূবমুখে গড়িয়ে গোটা তিব্বত পেরিয়ে অরুণাচলে এসে বাঁক নিলো দক্ষিণে। অল্পদূর পরেই ডিব্রুগড়ে মোড় ঘুরে রওনা দিল পশ্চিমে, যাব আসাম-মেঘালয়। বাবারে তাতেও শান্তি নেই, কোচবিহারের আগে কী মনে করে মোড় ঘুরে সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়লো বর্তমানের বাংলাদেশে, কুড়িগ্রাম জেলা দিয়ে। জিরোবি না তা বুঝলাম বাপু, তা সোজাসুজিও চলবিনে—শেরপুরের বাহাদুরাবাদ এসে আবার মোচড় মেরে চললো পূবে—সেই পূবে, উৎপত্তির পর যেদিকে প্রথম রওনা দিয়েছিল ব্রহ্মপুত্র। ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ হয়ে তার যাত্রা ফুরলো মেঘনা নদীতে।



ব্রহ্মপুত্র যে সে নদী নয়, নামেই বলে, একে তো নদ, তায় ব্রহ্মার পুত্র। তার জন্ম আর গতিপথ নিয়ে চমৎকার এক গল্প আছে। গল্প যদিও জুড়ে গেছে পৌরাণিক চরিত্রের সাথে, কিন্তু তাতে ইতিহাসের উপস্থিতি স্পষ্ট। তা পুরাণ থেকেই শুরু করি?

ষষ্ঠ অবতার পরশুরামের হাত থেকে অবশেষে কুঠার খসে পড়লো। পৃথিবীকে একুশবার ক্ষত্রিয়শূণ্য করে যে রক্তগঙ্গা বইয়েছিলেন, তার ফলে হাতের সাথে তাঁর কুঠার জুড়ে গেছিল। জড়বৎ হাত থেকে কিছুতেই তা সরছিল না। সে কুঠার অবশেষে মুক্ত হলো হিমালয়ে ব্রহ্মকুন্ড খুঁজে পাবার পর। পর্বতের গায়ে ক্ষুদ্র কুন্ড, তাতে জমা হয়ে আছেন স্বয়ং ব্রহ্মার পুত্র। তাঁর মাঝে স্নানে পাপক্ষয় ঘটে, পুণ্যলাভ হয়। যেমন হলো পরশুরামের। কিন্তু এই স্থানে লুকায়িত কেন ব্রহ্মপুত্র? পুণ্যার্থীদের তবে কী উপায় হবে, এতদূর দুর্গম পথ পেরিয়ে তারা আসবেই কেমন করে পুণ্যস্থানে?


উপায় বের করলেন পরশুরাম। ব্রহ্মপুত্র নিজেই যাবেন, পথ বানাবেন পরশুরাম। কীভাবে? নিজের কুঠারকে লাঙলের মতো ব্যবহার করে পাহাড়ের গায়ে ফাটল কাটলেন তিনি, নদীপথ টেনে নিয়ে চললেন হিমালয় থেকে ভাটিতে। দৈবগুণে বিশাল আকারপ্রাপ্তি ঘটেছে তাঁর, পাহাড়-পর্বত তাঁর কাছে তুচ্ছ। এই মহাত্রার শুরুতেই ব্রহ্মপুত্র অবশ্য সাবধান করেছিলেন, "থামবে না। যেখানে তোমার লাঙল থামবে, সেখানেই রহিত হবে আমার যাত্রা।" পরশুরাম থামলেন না, পাড়ি দিলেন দীর্ঘ পথ, পার্বত্য হিমালয় ছাড়িয়ে এসে পৌঁছুলেন ভাটি বঙ্গে। অবশেষে নারায়ণগঞ্জে এসে লাঙল থামলো তাঁর। শেষ হলো ব্রহ্মপুত্র'র গতিপথ আঁকা। যে স্থানে পরশুরামের লাঙল থেমেছিল, নারায়ণগঞ্জের সে স্থানের নাম হলো 'লাঙলবন্দ'।



"আপনি এখানেই থাকুন, নিজ মহিমায় বঙ্গ অঞ্চলে বিরাজ করুন। আমি আপনার কথা প্রচারে যাত্রা করবো সমগ্র অঞ্চলে।" বলে কাশী যাত্রা করলেন পরশুরাম। এদিকে, সুন্দরী শীতলক্ষ্যা কাছেই প্রবাহিত হচ্ছে শুনে নিজের সংযম হারালেন ব্রহ্মপুত্র। প্রবল বিক্রমে এগিয়ে চললেন তার সাথে মিলিত হতে, পথে প্লাবিত করে চললেন জনপদ। বহু প্রাণক্ষয় হলো, কৃষিজমি তলিয়ে গেল। এদিকে শীতলক্ষ্যা ভীত হলেন ব্রহ্মপুত্রের আস্ফালনে। নিজের যৌবন লুকিয়ে পরিণত হলেন বুড়িগঙ্গায়। কিন্তু বার্ধক্যে দেখেও শীতলক্ষ্যাকে চিনতে ভুল করলেন না ব্রহ্মপুত্র। তার ওপর উপগত হয়েই ক্ষান্ত হলেন। এবং চিরদিনের জন্য হয়ে পড়লেন মিতমহিমা।



ততক্ষণে পরশুরাম উপস্থিত হয়েছেন ঘটনাস্থলে। ভর্ৎসনা করে ব্রহ্মপুত্রকে বললেন, "এ আপনি কী করলেন! নিজের সংযম ভুলে গিয়ে কৌমার্য হারালেন, ঘটালেন প্রাণক্ষয়!"
কাতর মিনতি করলেন ব্রহ্মপুত্র, "আমার যৌবন হারিয়ে গেছে। আমার ধারা মিশে গেছে শীতলক্ষ্যায়। আমি আগে বুঝতে পারিনি। এখন আমার কী করার আছে?"
- "আমি আপনাকে অভিশাপ দিলাম। আপনার মৃত্যু হবে। এই পাপেই আপনি মরে যাবেন।" - "কিন্তু এই যে পুণ্য জল, তার কী হবে? যে নদের জলে স্নান করতে আপনি দিক-বিদিক বলে এসেছেন, সে পুণ্যার্থীদের কী উপায় হবে?" - "সে উপায় আর নেই। আপনার পুণ্যধারা এখন বিলুপ্ত।"

ব্রহ্মপুত্রের বহু অনুনয়ের পরে অভিশাপ শিথিল করলেন পরশুরাম। চৈত্র মাসের শুক্লা অষ্টমী তিথিতে ব্রহ্মপুত্রের পুণ্যদানের ক্ষমতা থাকবে। তার বাইরে, সারা বছর এই নদ আর সকল জলধারার মতোই, সাধারণ।

সেই যে ব্রহ্মপুত্রের মরণের কথা বলেছিলেন পরশুরাম, সে মরণ আদতেই ঘটেছিল। ইতিহাস বলে, ১৭৮৭ সালে তিস্তা নদীর গতি পরিবর্তনের ফলে, ভূপ্রকৃতির বিপুল পরিবর্তন ঘটিয়ে নদীটি এসে পতিত হয় ব্রহ্মপুত্রে। এর আগে সরাসরি পদ্মায় যেয়ে মিশত তিস্তা। কিন্তু এই পরিবর্তনের ফলে তিস্তা-ব্রহ্মপুত্রের মিলিত বিপুল জলধারা সোজা দক্ষিণে প্রবাহিত হতে শুরু করে যমুনা নামে। আর ব্রহ্মপুত্র নদের আদি গতিপথ, শেরপুর থেকে লাঙ্গলবন্দ, হয়ে পড়ে শীর্ণ, মৃতপ্রায়।

কিন্তু সে জলধারায়, লাঙলবন্দে, প্রতি বছর চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় পুণ্যস্নান। এখন—বাংলা মাস, আর চান্দ্র তারিখ-টা মিলিয়ে বলো দেখি, আজ কোন তিথি?
সঠিক। চৈত্র মাস, শুক্ল পক্ষের অষ্টমী তিথি।

মিথ এবং ফ্যাক্ট হুবহু মেলানো যায় না, আবার মিথের মাঝে ফ্যাক্ট খুঁজে পেলে তাকে ফেলে-ও দেওয়া যায় না। তবে মিথ সর্বদা এডাপ্টিভ, ইতিহাসের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে, নতুন বয়ানের সাথে জন্ম দিতে পারে নতুন মিথের। তাই পরশুরামের অভিশাপ আগে ঘটেছিল নাকি তিস্তার গতিপরিবর্তন, সে প্রশ্ন অবান্তর। গল্প শোনাতে তোমাদের ডেকে এনেছিলাম, সে গল্প এইক্ষণে ফুরলো।

তথ্যসূত্র : ১। বঙ্গদেশি মাইথলজি (২য় কিস্তি) -রাজীব চৌধুরী - সতীর্থ প্রকাশনা
২। Teesta River, wikipedia
৩। Brahmaputra River, wikipedia
৪। Google Map
#musarboijatra2025 #Puranas #indianmythology #RiversofBangladesh

Post a Comment

[blogger]

MKRdezign

Contact Form

Name

Email *

Message *

Theme images by Jason Morrow. Powered by Blogger.
Javascript DisablePlease Enable Javascript To See All Widget