About Me

এক লাখ পঁচিশ হাজার বছর আগে সৃষ্টি 'সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড"


সমুদ্রের দীর্ঘ জলরাশি আর অথৈ পানির বড় বড় ঢেউ হিসেবে সমুদ্র সকলের কাছেই প্রিয়। সমুদ্রের মোহনীয় সৌন্দর্য যে কাউকে খুব সহজেই আকৃষ্ট করে। সমুদ্রের উপরিভাগ যতোটা সুন্দর এর তলদেশ ঠিক ততোটাই রহস্যময়। এমন রহস্যময় একটি অংশ রয়েছে বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরে, যাকে বলে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড। এটি বঙ্গোপসাগরের একটি সংরক্ষিত স্থান। ব্যতিক্রমধর্মী ভৌগোলিক গঠন ও সামুদ্রিক জীব বৈচিত্র্যের প্রাচুর্যের কারণে বঙ্গোপসাগরে এই খাদটি বিশেষ ভাবে গুরুত্ব পায়।


সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড এর অর্থ হলো, যার কোনো তল নেই। বঙ্গোপসাগরের এই অঞ্চলটির নামকরণের পেছনে রয়েছে একটি রহস্য। আঠারশো শতকের শেষ দিকে ডুবে যাওয়া একটি বৃটিশ যুদ্ধজাহাজের খোঁজে এসেছিল দেশটির আরো কয়েকটি জাহাজ। এর সঙ্গে ছিল একদল জরিপকারীও। কোনো নিশানা না পেয়েই এর নাম দেয় সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড।

১ লাখ ৭৩ হাজার ৮০০ হেক্টর নিয়ে গঠিত সংরক্ষিত এলাকাটি সবার নজরে আসে ২০১৪ সালে। গভীরতম এ উপত্যকাটি প্রায় দেড় হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এবং গড় গভীরতা প্রায় ২৬০০ মিটার। এখানকার ডুবো গিরিখাত বঙ্গীয় উপবদ্বীপের অংশ। যা বিশ্বের বৃহত্তম ডুবো গিরিখাত।

সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের উত্পত্তি নিয়ে কিছু মতভেদ থাকলেও সাধারণভাবে মনে করা হয় অঞ্চলটি এক লাখ পঁচিশ হাজার বছর আগে সৃষ্টি হয়েছিল। ইতিহাসের তথ্য মতে, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র ব-দ্বীপের পশ্চিমে অবস্থিত বঙ্গোপসাগরের মধ্যকার এ গভীর খাদটি ‘গঙ্গা খাদ’ নামে পরিচিত। বিশ্বের বড় ১১টি বড় উপত্যকার একটি।



কথিত রয়েছে ১৮৬৩ সালে গ্যাডফ্লাই নামে ২১২ টন ওজন বিশিষ্ট গানবোট ভারত থেকে ইংল্যান্ডে বিপুল পরিমাণ ধনরত্ন নিয়ে যাওয়ার সময় ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়। ডুবে যাওয়া সেই ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজের খোঁজে এসেছিল দেশটির আরো কয়েকটি জাহাজ। তাদের সঙ্গে ছিল এক জরিপকারী দল। শেষ পর্যন্ত ডুবে যাওয়া জাহাজের হদিস না পেয়ে এই অঞ্চলটির নাম দেওয়া হয় সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড অর্থাত্ যার কোনো তল বা সীমা নেই। স্থানীয় জেলেরা অঞ্চলটিকে বলে ‘নাই বাম’। কারণ জেলেরা ফুট বা মিটারে সমুদ্রের গভীরতা পরিমাপ না করে বাম হিসেবে যেমন দশ বাম, বিশ বাম এভাবে পরিমাপ করে থাকে। এই অঞ্চলটি এতোটাই গভীর যার কোনো বাম পাওয়া যায় না, সেজন্য জেলেরা ‘নাই বাম’ বলে থাকে।

প্রশান্ত মহাসাগরের গভীর খাদ মারিয়ানা ট্রেঞ্চের মতো। বঙ্গোপসাগরের অন্যতম মাছের ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডে নানা জাতের সামুদ্রিক মাছের পাশাপাশি আছে বিশাল তিমি, ডলফিন, হাঙর, কচ্ছপ আর বিরল প্রজাতির কিছু জলজপ্রাণী। প্রায় দেড় হাজার বর্গমাইলের বিস্তীর্ণ এলাকাটি বিরল জীববৈচিত্রের নিরাপদ প্রজননকেন্দ্র। এসব সামুদ্রিক প্রাণীর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো তিমি, পপাস ডলফিন, পৃথিবীর বৃহত্তম ইরাবতী ডলফিন, গোলাপি পিঠের কুঁজো ইন্দো প্যাসিফিক ডলফিন ও মসৃন পিঠের (পাখনাহীন) ইমপ্লাইস ডলফিন। এছাড়া এটি ডলফিন পরপাস ও তিমির প্রজননক্ষেত্রও। বিজ্ঞানীদের মতে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড পৃথিবীর একমাত্র স্থান যেখানে ডলফিন, পরপাস ও তিমি—এই তিন প্রজাতির সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী একসঙ্গে দেখা যায়। এই সামুদ্রিক অঞ্চলে সী-গালসহ দশ প্রজাতির পাখি, ত্রিশ প্রজাতির মাছ, ব্রিড তিমি এবং মিল্কি তিমিসহ অসংখ্য জীববৈচিত্র্যের সন্ধান পাওয়া যায়।

 


জায়গাটি সমুদ্রবিজ্ঞানীদের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার ক্ষেত্র। এখানে সমুদ্রের গভীর অংশের পরিবেশ এবং জীবনের বৈচিত্র্য সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়। এই অঞ্চলটি কার্বন চক্র এবং সমুদ্রের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা পালন করে। বঙ্গোপসাগরের স্রোত এবং বায়ুপ্রবাহ এই অঞ্চলের জলবায়ুর ওপর প্রভাব ফেলে।

 

সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড দেশের সম্ভবনাময় ব্লু ইকোনমির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল। এখানকার পানির গুণগতমান শ্রীলংকা, ভারত, মিয়ানমার ও মালদ্বীপের চেয়েও উন্নত। বিশেষ করে সুন্দরবনের ইকোসিস্টেম এবং জীববৈচিত্র্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চল। সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড সুন্দরবন অঞ্চলের জন্য ইকোলজিক্যাল ফিল্টার হিসেবে কাজ করছে। এছাড়া এখানে যে মাছ ও প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, তার সঠিক ব্যবহার করতে পারলে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি লাভ করা সম্ভব।

 

মনে চাইলে যেতে পারেন সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড

সমুদ্রের দীর্ঘ জলরাশির বুকে জলজ প্রানীর অবাধ বিচরণ ও দিগন্তে উরে বেড়ানো পাখিদের কোলাহল স্বচক্ষে দেখতে চাইলে জীবনে একবার হলেও ঘুরে আসতে হবে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড। বঙ্গোপসাগরের বুকে জেলে নৌকায় ভেসে ভেসে মাছ ধরার দৃশ্য আপনাকে মুগ্ধ না করে পারবে না। রাতের সোয়াচ দেখতে দেখতে হঠাৎ ডলফিন বা তিমির হুটোপুটি বাংলাদেশে বসেই উপভোগ করা সম্ভব। প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যের সৌন্দর্য যে কতোটা মনোমুগ্ধকর হতে পারে তা সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডে গেলে অনুভব করা সম্ভব। আপনি যদি খুব বেশি এডভেঞ্চার প্রেমী হয়ে থাকেন তাহলে এই সামুদ্রিক খাদের পাশ থেকে ঘুরে আসা মিস করবেন না। নৌকার দুলুনি, রাতের সমুদ্র, সামুদ্রিক প্রাণী ও পাখির বিচরণ এই সবকিছুই উপভোগ করতে পারবেন সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড ভ্রমনের মাধ্যমে।

 


সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড যাওয়ার উপায়:

সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড দুইভাবে যাওয়া যায়। সবথেকে সহজ মাধ্যম হলো মংলা থেকে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড যাওয়া। আর দ্বিতীয় মাধ্যম হলো কুয়াকাটা হয়ে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড যাওয়া। তবে কুয়াকাটা থেকে সব সময় সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড যাওয়ার ট্রলার পাওয়া যায় না। দেখে নিন ভিন্ন ভিন্ন দুইটি পদ্ধতিতে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড যাওয়ার উপায়-


মংলা হয়ে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড-

মংলা হয়ে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড যাওয়ার জন্য প্রথমে ঢাকা থেকে সরাসরি মংলা যাওয়ার বাস ধরতে হবে। ঢাকার সায়দাবাদ থেকে সরাসরি মংলা যাওয়ার বাস পাওয়া যায়। সায়দাবাদ থেকে হানিফ এন্টারপ্রাইজ কিংবা দিগন্ত পরিবহনের বাসে চেপে সরাসরি মংলা পৌঁছাতে পারবেন।

ইকোনোমি ক্লাসে জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ৭০০ টাকা। মংলা থেকে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার, তাই যাতায়াতে খুব বেশি সময় লাগে না। মংলা থেকে প্রতিদিনই সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের উদ্যেশ্যে মাছ ধরার জাহাজ ছেড়ে যায়। একটু খোঁজ খবর নিয়ে দেখতে পারেন কোনো জাহাজ সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের দিকে যাবে কিনা।

ভাগ্য ভালো হলে জাহাজে চেপে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড দেখার সৌভাগ্য হতেও পারে। তবে জেলে নৌকায় ভ্রমনের আগে সামুদ্রিক আবহাওয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেয়া জরুরি। সার্বিক আবহাওয়া অনুকূল হলে তবেই যাত্রা শুরু করা উচিত।

রাতে থাকা ও খাওয়া সব মিলিয়ে খরচের বিষয়টি যাত্রার আগেই নৌকার মালিকের সাথে চুক্তি করে নেয়া ভালো। জেলে নৌকাগুলো সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের কাছাকাছি একটি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে মাছ ধরে। সেখান থেকেই সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের ভিউ উপভোগ করতে পারবেন। এক্ষেত্রে একই খরচে সুন্দরবন থেকেও ঘুরে আসতে পারেন।

 

কুয়াকাটা হয়ে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড

কুয়াকাটা থেকে অগ্রিম খোঁজ খবর রাখার ব্যবস্থা থাকলে তবেই কুয়াকাটা থেকে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড যাওয়ার পরিকল্পনা করতে পারেন। কেননা কুয়াকাটা থেকে সব সময় সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড যাওয়ার জন্য ট্রলার পাওয়া যায় না। পরিচিত কেউ থাকলে বা তথ্য সংগ্রহের কোনো লিংক থাকলে আগে থেকে জেনে নিন কুয়াকাটা থেকে ট্রলার কোন কোন সময়ে পাওয়া যাবে।

পদ্মা সেতু চালু হওয়ার সুবাদে ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে চেপে কুয়াকাটা যাওয়া যায়। ঢাকার সায়দাবাদ থেকে হানিফ, সাকুরা পরিবহন, সেভেন স্টার সহ আরও বেশ কয়েকটি বাস সরাসরি কুয়াকাটার উদ্যেশ্যে ছেড়ে যায়। জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা।




কুয়াকাটা থেকে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড যাওয়ার জন্য ট্রলারে প্রায় ৯০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে। সবকিছু আগে থেকে চুক্তি করে ট্রলারে চেপে কুয়াকাটা থেকে ঘুরে আসতে পারেন সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড এর অসাধারণ রোমাঞ্চকর সৌন্দর্য। এক্ষেত্রে একই সাথে কুয়াকাটা ভ্রমণের অভিজ্ঞতাও অর্জন করা হবে।

থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা

জেলে নৌকায় ভ্রমনে করলে রাতে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা নৌকায়ই থাকবে। যেহেতু ভ্রমনের আগেই নৌকার মালিকের সাথে চুক্তি করে নেয়া হবে। তাছাড়া কুয়াকাটা ও মংলা শহরে থাকার জন্য বেশ ভালো মানের আবাসিক হোটেল থেকে শুরু করে সাধারণ মানের অনেক হোটেল পাবেন।

এসকল হোটেলে ৭০০ টাকা থেকে শুরু করে ৩০০০ টাকা বা তার বেশি দামে থাকার জন্য রুম পেয়ে যাবেন। তাছাড়া খাওয়ার জন্য মংলা শহরে সাধারণ মানের বেশ কিছু হোটেল পাবেন। কুয়াকাটায় খাওয়ার জন্য বৈচিত্র্য সব মাছ ও ভর্তার আইটেম সমৃদ্ধ খাবার হোটেল পাবেন। তবে নৌকায় যাত্রা শুরু করার আগে সাথে কিছু শুকনো খাবার নিয়ে নেয়া উচিত।

এই ছিলো সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড ভ্রমণ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য। আশাকরি একটি ব্যতিক্রমধর্মী ট্যুর প্লান করার জন্য আজকের আর্টিকেলটি একটু হলেও আপনাকে সহায়তা করবে। একটি ট্যুর প্লান করার আগে যাতায়াতের যাবতীয় তথ্য ও আবহাওয়ার সার্বিক দিক বিবেচনা করে তবেই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। একটি সুন্দর ও সুপরিকল্পিত ভ্রমনের শুভেচ্ছা রইল আপনার জন্য। ধন্যবাদ।


Post a Comment

0 Comments