অনলাইনে ৬৮ শতাংশ নারী হয়রানি এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার !
মিথিলা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে ফেরার পথে মেসেঞ্জারে অপরিচিত অ্যাকাউন্ট থেকে বিকৃত মেসেজ পান। ব্যাপারটি তিনি পাত্তা না দিয়ে বাড়ি পৌঁছান। এরপর রাতে সেই অ্যাকাউন্ট থেকেই প্রথমে মেসেঞ্জারে অডিও কল ও কিছুক্ষণ পর থেকেই ভিডিও কল পেতে থাকেন। কল রিসিভ না করে উপেক্ষা করায় আসতে থাকে অশ্লীল ছবি।
এটা শুধু মিথিলার সঙ্গেই ঘটেছে , তা নয়। প্রায় বেশিরভাগ নারী কোনো না-কোনোভাবে অনলাইনে এমন হয়রানির শিকার হয়েছেন। আমাদের সমাজব্যবস্থায় এসেছে বহু পরিবর্তন। কিন্তু নারীদের হয়রানি, হেনস্তা আর নির্যাতনের দিকটি যেনো এখনো অপরিবর্তিত। সময়ের সঙ্গে পাল্টেচ্ছে নারী নির্যাতনের ধরন। প্রযুক্তির কল্যাণকে কাজে লাগিয়ে বেড়েই চলেছে নারীর উপর সাইবার হয়রানি।
অনলাইনে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীরা সাইবার বুলিং, আইডি হ্যাক, স্পর্শকাতর তথ্য, ছবি, ভিডিও প্রকাশ, সাইবার স্পেসে যৌন হয়রানি ইত্যাদি অপরাধের শিকার হয়ে থাকেন। সাইবার জগতে নারীর ওপর হয়রানি এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এক জরিপের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ১৬ থেকে ২৪ বছরের নারীরা এ অপরাধে সবচেয়ে বেশি শিকার হন এবং ৬৮ শতাংশ নারী সাইবার জগতে সাইবার অপরাধের শিকার। অনলাইন বা সামজিক যোগযোগ মাধ্যম এখন অনেক নারীর কাছেই এক আতঙ্কের নাম।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের একটি জরিপে দেখা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশে যত সাইবার অপরাধ হয়, এর প্রায় ৭০ শতাংশের শিকার হচ্ছেন নারীরা। নারীদের যেসব অপরাধের শিকার হয়ে বেশি ভুগতে হয় সেগুলো হচ্ছে-ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া বা হুমকি দেওয়া বা হুমকি দিয়ে অর্থ আদায় করা, ফেসবুক আইডি হ্যাক করা, বস্ন্যাকমেইলিং করা, ছবি বা ভিডিও এডিট বা সুপার ইম্পোজ করে ছড়িয়ে দেওয়া, অশ্লীল ছবি দিয়ে আপত্তিকর কনট্যান্ট বা ফেক আইডি তৈরি করা, সাইবার বুলিং বা ফোন নম্বর ছড়িয়ে দেওয়া, হয়রানিমূলক এসএমএস, মেইল বা লিংক পাঠানো।
সম্প্রতি আরেকটি বেসরকারী সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, অনলাইনে বিড়ম্বনার শিকার হন ৪৩.৮৯ শতাংশ নারী। এর মধ্যে কুরুচিপূর্ণ মেসেজ পাঠিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলা হয়েছে ৬১.১২ শতাংশকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আইডি হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছে ১০.৩৪ শতাংশ। ৯.৮৯ শতাংশ ব্যক্তিগত ও সংবেদনশীল ছবি নিয়ে দুর্ভোগ পোহান।
অনলাইন জীবনেও একটি পরিমিতিবোধ থাকা দরকার। অনলাইনে বন্ধু বেছে নেবার ক্ষেত্রেও নিজেকে এবং পরিবারকে সচেতন হতে হবে। পরিচিত ব্যক্তির থেকে নারীরা সহিংসতার শিকার হয়, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রকাশ করে না। এই সুযোগে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। আর এই ট্রমা থেকে সারাজীবন রক্ত ঝরে। তাই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার শিকার হলে সবার আগে সবচেয়ে কাছের মানুষ কিংবা পরিবারকে অথবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অভিযোগ জানানো উচিত। এসব নির্যতন থেকে মুক্তি পেতে নারীদের মুখ খুলতেই হবে।
সাইবার অপরাধের শিকার নারী কোথায় অভিযোগ জানাবেন:
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীরা তাদের ওপর ঘটে যাওয়া অপরাধ সম্পর্কে অভিযোগ করেন না। তারা যাতে নির্দ্বিধায় অভিযোগ করতে পারেন, সেজন্য নারীদের সাইবার সহায়তা দেওয়ার জন্য পুলিশ সদর দপ্তরের এলআইসি শাখার অধীন চালু করা হয়েছে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন বা পিসিএসডব্লিউ ইউনিট। এখানে অভিযোগ করতে ফেসবুকে পিসিএসডব্লিউ এর পেজে (www.facebook.com/PCSW.PHQ) মেসেজ দিতে হবে অথবা তাদের ইমেলে (cybersupport.women@police.gov.bd) মেইল করে জানাতে হবে অথবা এই ইনিটের হট লাইন (01320000888)নম্বরে কল দিয়ে জানাতে হবে। অভিযোগকারীর পরিচয় গোপন রেখে এ ইউনিটের নারী পুলিশ সদস্যরা প্রয়োজনীয় সেবা ও আইনি সহায়তা দিতে কাজ করেন।
সাইবার হয়রানি থেকে সুরক্ষা দিতে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগে একটি সাইবার হেল্প ডেস্কও রয়েছে। এই হেল্পলাইন (০১৭৬৬৬৭৮৮৮৮) সপ্তাহের সাত দিন, ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। বাংলাদেশের যে কোন জায়গা থেকে যে কেউ হেল্পলাইনে সরাসরি ফোন করে অথবা এসএমএসের মাধ্যমে অভিযোগ জানাতে পারবেন। এছাড়া সাইবার হয়রানি থেকে রক্ষা পেতে হটলাইন '৯৯৯' চালু করেছে সরকার। যে কেউ সাইবার অপরাধের শিকার হলে এই হটলাইনে ফোন করেও অভিযোগ জানাতে পারবেন।
আমীর মুহাম্মদ. সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক ইত্তেফাক।
Post a Comment