পরিবার বা কর্মক্ষেত্রে অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন
নারী নির্যাতনের কথা বললে প্রথমেই আমাদের মনের মাঝে উঁকি দেয় শারীরিক, মানসিক, এবং যৌন নির্যাতনের কথা। কিন্তু নারীরা বিভিন্নভাবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে নির্যাতন বা বৈষম্যের শিকার হন তার ব্যাপকতার কথা প্রায়শই আমরা গণ্য করি না। নিম্ন, মধ্য এবং উচ্চবিত্ত সব শ্রেণিতেই হাজারও নারী আছেন,যারা নিয়মিত পরিবার বা কর্মক্ষেত্রে অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। দেখা যায় আমাদের সমাজে প্রায় প্রতিটি পরিবারে টাকা পয়সার নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্নটায় স্বামীর হাতে। স্ত্রীর অধিকারপ্রাপ্ত টাকা পয়সা বা সম্পত্তিরও নিয়ন্ত্রণ করছে স্বামী।
এক জরিপে দেখো গেছে, বিবাহিত নারীদের প্রায় অর্ধেকই জীবনে কখনো না কখনো স্বামীদের হাতে অর্থনৈতিকভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। জরিপভুক্ত বিবাহিত নারীদের ৮৫ শতাংশের নিজেদের আয়ের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাঁর বেতনের পুরো টাকা স্বামী নিয়ে নেন। দৈনন্দিন খরচের টাকাও মাঝেমধ্যে ঝগড়াঝাঁটি করে আদায় করতে হয়।
অনেক পরিবারে টাকা থাকা সত্ত্বেও স্ত্রী তথা সঙ্গিনীর হাতে পর্যাপ্ত সংসারখরচ দিচ্ছে না, যৌতুক দাবি করা হচ্ছে এবং বাবার বাড়ি থেকে টাকা বা জিনিসপত্র আনতে চাপ দিচ্ছে। আবার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্যও স্বামী টাকা খরচ করতে চান না। যেকোনো দরকারে বাবার বাড়ি থেকে টাকা আনতে হয়। যেখানে নারীরা বেঁচে থাকার জন্য স্বামীর আয়ের উপর নির্ভরশীল, সেখানে নারীদের উপর অর্থনৈতিক নির্যাতন খুব মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনতে পারে। অর্থনৈতিক নির্যাতনকেন্দ্রিক সম্পর্কগুলোতে মা এবং কন্যাসন্তাদের সীমিত স্বাস্থ্যসেবাপ্রাপ্তিসহ অন্যান্য নির্যাতনেরও শিকার হন।
আবার পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কারণে অনেক ক্ষেত্রে নারীর নিজের উপার্জিত অর্থ ভোগ করতে পারেন না। সংসারে অভাবঅনটন না থাকলেও, পারিবারিক আর্থিক বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধাপ্রাপ্ত হওয়া হচ্ছে নারী। অর্থ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে নারীর মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া হয় না। পরিবারের অর্থ ব্যয়ের সিদ্ধান্ত প্রায় শতভাগ সরাসরি অথবা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে পুরুষেরাই নিচ্ছেন। পরিবারের নারীকে নথিপত্র স্বাক্ষর করতে, জিনিস বিক্রি করতে বা উইল পরিবর্তন করতে বাধ্য করা বা চাপ দেওয়ার মাধ্যমেও অর্থনৈতিক নির্যাতন করা হচ্ছে। এছাড়া নারীদের সম্পত্তি, জমির মালিকানা, উত্তরাধিকার, কর্মসংস্থানে বেতন বৈষম্যের কারনে নারী অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এভাবে অর্থনৈতিক নির্যাতনের মাধ্যমে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হচ্ছে।
কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পরিবার থেকে অনেক সময় নিরুৎসাহিত এবং কখনও কখনও বাধা প্রদান করা হয়। একদিকে নারীকে অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হতে না দেওয়া, অন্যদিকে মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ দিতে অস্বীকৃত করার মাধ্যমে বর্তমান সমাজে নারীদের অর্থনৈতিক নির্যাতন করা হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে দেখা যায় নারীরা পুরুষদের সমপরিমাণ কাজ করেও অসম বা কম বেতন পেয়ে থাকেন। অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার নারীরা অনেক সময় প্রয়োজনীয় চাহিদা হতে বঞ্চিতও হয়ে থাকেন।
অর্থনৈতিক নির্যাাতন প্রতিরোধযোগ্য। অন্যান্য নির্যাতনের মতো অর্থনৈতিক নির্যাতন প্রতিরোধ করতে নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পাশাপাশি নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে হবে । পাশাপাশি তা দাবি করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। নারীদের সম্পত্তি, জমির মালিকানা, উত্তরাধিকার, কর্মসংস্থান, একই কাজের জন্য পুরুষের সমান মজুরি নিশ্চিত করতে হবে। পুরুষকেও এ ব্যাপারে সচেতন করতে হবে। তা না হলে নারী যুগেরপর যুগ ধরে পরিবারে এবং কর্মক্ষেত্রে অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হতেই থাকবে।
Post a Comment